প্রতিক্ষণ ডট কম:
সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়া ৪ টি এমএলএম কোম্পানির লাইসেন্স নবায়নের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পরও নবায়ন করা হয়নি কোন কোম্পানির লাইসেন্স। ২০১৪ সালে লাইসেন্স পাওয়া কোম্পানিগুলোর নবায়নের শেষ সময় ছিলো গত ৪ মার্চ। অথচ এ সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি।
প্রচলিত বিধিমালা অনুযায়ী লাইসেন্স নবায়ন না হবার কারণে এসব কোম্পানির কার্যক্রম অবৈধ বলে বিবেচিত হতে পারে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘এমএলএম এর নামে প্রতারণা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রচারিত হলে সরকারের টনক নড়ে। সাধারণ মানুষ যাতে এমএলএম নামধারী ইউনিপে, স্পিক এশিয়া, লাভিং টাচ, এনলাভিং, এমিটাচ ও ফাইটোসাইন্স এর মত বিনিয়োগ সর্বস্ব মানিগেম কোম্পানিগুলো দ্বারা প্রতারিত না হয় সেজন্য জাতীয় সংসদে এমএলএম বিল ২০১৩ উত্থাপিত হয়। ডাইরেক্ট মার্কেটিং এর নামে কেউ যদি এ জাতীয় মানিগেম কোম্পানিগুলো দ্বারা প্রতারিত হয়, তবে তার জন্য কোম্পানির পরিচালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখেই প্রণীত হয় এম এল এম নিয়ন্ত্রণ আইন।
আর এই এমএলএম আইন অনুযায়ী গত বছরের ৫ মার্চ মডার্ন হারবাল ফুড লিমিটেড, ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেড, স্বাধীন অনলাইন পাবলিক লিমিটেড এবং রিচ বিজনেস সিস্টেম লিমিটেড নামে চার এমএলএম কোম্পানিকে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স দেয় জয়েন্ট স্টক কোম্পানি।
সরকার লাইসেন্স দেয়ার পর ডেসটিনিসহ বিভিন্ন কোম্পানি থেকে দলে দলে বেকার যুবকরা এই চারটি কোম্পারি সাথে এমএলএম ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তাদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘সরকার যেহেতু লাইসেন্স দিয়েছে সুতরাং ভয়ের কোন কারণ নাই। কোম্পানিগুলো প্রতারণা করলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। সেকারণেই দলে দলে বেকার জনগোষ্ঠী এই ব্যবসায় যোগ দিচ্ছে।’
এসব কোম্পানির ক্রেতা পরিবেশকরা আরো জানায়,‘ আমরা অনেকেই কোম্পানিগুলো থেকে ভাল আয় করছি এবং অন্যকে আয়ের পথ দেখাচ্ছি। কিন্তু কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নবায়ন না করায় এখন আমরা নিজেদের ভবিষৎ নিয়ে আতঙ্কিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুএকজন জানায়, নবায়ন না করার ফলে ঘরে ঘরে আরো বেকার জন্ম নেবে। ফলে রাস্তাঘাটে চুরি ছিনতাই বাড়বে।’ এ কারণেই কোম্পানিগুলোকে কঠোর মনিটরিং এ রেখেই লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ দেয়া উচিত বলে জানান সাধারণ ক্রেতা পরিবেশকরা।
এদিকে কোম্পানিগুলো বলছে, ‘নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট সময়ে চার কোম্পানি জয়েন্ট স্টকে নবায়নের জন্য আবেদন করলেও কোনো কোম্পানিকেই নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়নি।’ কী কারণে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি, তাও তাদের জানানো হয়নি বলে কোম্পানিগুলো দাবি করে। এ বিষয়ে জয়েন্ট স্টকে সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, জয়েন্ট স্টক থেকে লাইসেন্স পাবার পরও বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এমএলএম কোম্পানির লাইসেন্স আরো যাচাই বাছাই করে দেয়া উচিত ছিলো বলে গণমাধ্যমে মন্তব্য করেন। আর এরপর থেকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে জয়েন্ট স্টক রেজিষ্ট্রেশনের আর কোন ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এই পরিদফতরের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ‘লাইসেন্স জয়েন্ট স্টক রেজিষ্ট্রেশন দিলেও কারও লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানের নেই। কেবলমাত্র বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সব ধরনের যাচাই বাছাই শেষে কোম্পানিগুলোর বিষয়ে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এমএলএম নিয়ে সংসদীয় কমিটি একটি তদন্ত করছে। এ কারণে চুড়ান্ত পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হতে পারে।’
এদিকে লাইসেন্স বিধিমালা অনুযায়ী আরজেএসসি নতুন কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে এসব কোম্পানির কার্যক্রম অবৈধ হয়ে যাবে। মূলত একারণেই কোম্পানিগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন লাইসেন্স পাওয়া চার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। এর পাশাপাশি বেকার হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার ক্রেতা পরিবেশকের। ক্রেতা পরিবেশকদের মতে, ‘কোম্পানিগুলো দূর্নীতি করলে সরকার প্রশাসক বসাবে, প্রয়োজনে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেবে। আর তা না করে সরকার হঠকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
ওয়ার্ল্ড মিশন ২১ লিমিটেডের মার্কেটিং ডিরেক্টর জাকির হোসাইন বলেন, ‘সরকার সংসদে আইন করে এমএলএম ব্যবসার সুযোগ দিয়েছে। এখন কোনো কারণ ছাড়া লাইসেন্স নবায়ন না করলে তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। হাজার হাজার মানুষ বেকার হবে।’ তিনি বলেন,‘ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ দেবে বলে আমরা আশা করছি।’
জানা গেছে, আইন অনুযায়ী বৈধভাবে এমএলএম ব্যবসা করার সুযোগ থাকলেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি লাইসেন্স নবায়নের বিষয়েও কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে আরজেএসসি লাইসেন্স দানকারী প্রতিষ্ঠান হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া তারাও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নবায়নের সিদ্ধান্ত না নিলে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এ বিষয়ে রিচ বিজনেস সিস্টেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসাইন মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ‘তারা আইন ও বিধিবিধান মেনে এমএলএম ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। এখন সরকার তাদের লাইসেন্স নবায়ন করছে না। তাই বিনিয়োগ সুরক্ষায় তাদেরকে এখন আদালতে যেতে হবে’। চলতি সপ্তাহে তারা আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান তিনি।
চার এমএলএম কোম্পানি মনে করে, আইন করেও সরকার লাইসেন্স নবায়ন না করাটা দুঃখজনক। সরকার গত বছর যে চারটি কোম্পানির লাইসেন্স দিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে এক বছরে কোনো অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি। তাছাড়া আরজেএসসি কেন তাদের লাইসেন্স নবায়ন করছে না তাও জানায়নি। কোনো অভিযোগ না থাকলে আইন অনুযায়ী তাদের লাইসেন্স নবায়ন হওয়ার কথা। কিন্তু আরজেএসসি এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি।
এদিকে লাইসেন্সপ্রাপ্তরা নবায়নের সুযোগ না পেলেও লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছে নাম সর্বসন্ব প্রায় ১০০ টি ওয়েব বেজ এমএলএম নামধারী কোম্পানি। এদের মধ্যে ফোরেস্ক ট্রেড, ফাইটো সাইন্স, টিভিআইসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিদেশি মানিগেম কোম্পানিতে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে দৈনিক ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ এর অভিযোগ রয়েছে। আর এই টাকার সিংহভাগই মানিলন্ডারিং এর মাধ্যমে প্রতিদিনই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এলএলএম সংশ্লিষ্টরা।
এর বাইরেও কিছু কোম্পানি রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মসহ প্রতারণার অভিযোগ থাকলেও সরকারি কোনো নজরদারি ছাড়াই চলছে তাদের ব্যবসা।
এর মধ্যে ফাইটো সাইন্স নামক লাইসেন্সবিহীন একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে পিরামিড সেলিং এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ইউনিপে থেকে টাকা হাতিয়ে নেবার অভিযোগে এই কোম্পানির মালিক জাহাঙ্গীর আলম ওরফে এমজে আলম এর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা দায়ের হয়েছিল। মূলত এ জাতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারণেই লাইসেন্স পাওয়া প্রকৃত এমএলএম কোম্পানিগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন এমএলএম সংশ্লিষ্টরা। শিগগিরই প্রতারক কোম্পানিগুলো বন্ধ করে সঠিক কোম্পানিগুলোকে ব্যবসার সুযোগ দেবার জোর দাবি জানান তারা।
প্রতিক্ষণ/এডি/রাকিব